মানুষ, জীবজগৎ, প্রকৃতি ও পৃথিবীর প্রতি ভালোবাসা

তৃতীয় শ্রেণি (প্রাথমিক স্তর ২০২৪) - ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা - | NCTB BOOK

মানুষ, জীবজগৎ, প্রকৃতি ও পৃথিবীর প্রতি ভালোবাসা

প্রকৃতি ও জীবজগতের পরিচয়

আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে তার সবকিছু মিলে প্রকৃতি। প্রকৃতিতে রয়েছে চন্দ্র, সূর্য, পৃথিবী, সাগর-মহাসাগর, পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী, বায়ু, পানি, মাটি ইত্যাদি। প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীবজগতের সকল কিছুই মহান আল্লাহর সৃষ্টি এবং এসব তাঁরই আদেশে পরিচালিত হয়। এ সকল কিছু আমাদের জন্য মহান আল্লাহর নিয়ামত।

মহান আল্লাহ প্রকৃতিতে জড় ও জীবের সৃষ্টি করেছেন। এই জড়জগৎ ও জীবজগৎ পৃথিবীর উপাদান। এর কোনোটা আমরা খেয়ে বেঁচে থাকি আবার কোনোটা আমরা ব্যবহার করি। যেমন- গাছপালা থেকে আমরা ফলমূল পাই। জীবজন্তু থেকে আমরা নানা রকম খাদ্য পাই।

চিত্র: প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীবজগৎ

বেঁচে থাকার জন্য আমরা প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীবজগতের ওপর নির্ভরশীল। আমাদের বাঁচার জন্য পানি দরকার। পানির অপর নাম জীবন। অক্সিজেন ছাড়া আমরা শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে পারি না। গাছপালা থেকে আমরা অক্সিজেন পাই। এছাড়া সূর্য আমাদের আলো দেয়। সূর্যের আলো ও তাপ না থাকলে পৃথিবী অন্ধকার ও বরফ হয়ে যেতো।

মহান আল্লাহ পাহাড়, পর্বত, সমুদ্রসহ আরও অনেক কিছু সৃষ্টি করেছেন আমাদের উপকারের জন্য। এ সম্পর্কে তিনি পবিত্র কুরআনে বলেছেন,

هُوَ الَّذِي خَلَقَ لَكُمْ مَا فِي الْأَرْضِ جَمِيعًا

বাংলা উচ্চারণ: হুয়াল্লাযি খালাকা লাকুম্ মা ফিল আরদি জামিয়া।

অর্থাৎ, “তিনি (আল্লাহ) পৃথিবীর সবকিছু তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন।" (সূরা বাকারা: ২৯)

মহান আল্লাহ এই পৃথিবীর সবকিছু সৃষ্টি করে আমাদেরকে এর রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব দিয়েছেন। তাই আমাদের উচিত প্রকৃতি, জীবজগৎ ও পরিবেশকে জানা এবং এদের প্রতি যত্নবান হওয়া।

ক) বিষয়বস্তু পড়ি ও ভাবি। আমাদের চারপাশের প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীবজগতের ৫টি উপকারী উপাদানে নাম লিখি। কাজটি একাকী করি।

খ) নিচের ডান ও বাম পাশের তথ্যগুলো দাগ টেনে মিল করি। কাজটি জোড়ায় করি।

মহান আল্লাহপ্রকৃতি, জীবজগৎ ও পরিবেশকে জানা এবং এদের প্রতি যত্নবান হওয়া 
আমাদের চারপাশে যা কিছু আছেজীবন
গাছপালা থেকে আমরাতার সবকিছু মিলে প্রকৃতি
জীবজন্তু থেকে আমরাপাহাড়, পর্বত, সমুদ্রসহ আরও অনেক কিছু সৃষ্টি করেছেন
পানির অপর নামঅক্সিজেন পাই
আমাদের উচিতনানা রকম খাবার পাই

গ) আমাদের জীবনে প্রকৃতি ও জীবজগতের অবদান বর্ণনা করে চারটি বাক্য লিখি। কাজটি জোড়ায় করি।

মানুষ, প্রকৃতি ও জীবজগতের পারস্পরিক সম্পর্ক

আমরা প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীবজগতের ওপর নির্ভরশীল। আমরা ঘরে আলো দেখি। এ আলো সূর্য থেকে আসে। সূর্য না থাকলে পৃথিবী অন্ধকার থাকত। শীতের মৌসুমে রোদ না থাকলে সবকিছু শীতল হয়ে যায়। একইভাবে সূর্যের আলো না থাকলে পৃথিবী বরফ হয়ে যেতো। পৃথিবীর কোনো জীবই বাঁচতে পারত না। মেঘ থেকে বৃষ্টি হয়। ফলে আমরা শান্তি অনুভব করি। আবার বৃষ্টি না হলে খরা দেখা দিতো, কোনো ফসল-ফলাদি হতো না। আমাদের চারপাশে নদ-নদী ও খাল-বিল দেখতে পাই। নদী পথে আমরা চলাচল করি। এছাড়া নদী থেকে আমরা খাবারের মাছ পেয়ে থাকি। নদীর পানি দিয়ে আমরা ফসল উৎপাদন করি।

চিত্র: মানুষ, নদ-নদী, খাল-বিল ও উদ্ভিদ

গাছপালা থেকে আমরা ফলমূল, শাকসবজি ও অন্যান্য খাদ্য উপাদান পাই। গাছ থেকে আমরা কাঠ ও আসবাপত্র পাই। কাঠ জ্বালানি হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। আমাদের শ্বাস- প্রশ্বাসের জন্য যে অক্সিজেন দরকার তাও গাছপালা থেকে আসে।

চিত্র: মানুষ, প্রকৃতি ও জীবজগৎ

আমাদের গৃহপালিত অনেক পশুপাখি রয়েছে। গরু আমাদের দুধ দেয়। গরুর দুধ থেকে বিভিন্ন রকম মিষ্টিজাতীয় খাবার তৈরি করা হয়। আমরা গরু, মহিষ ও ছাগলের গোশত খাই। গরু ও মহিষ দিয়ে জমি চাষাবাদ করা হয়। হাঁস-মুরগি থেকে গোশত ও ডিম পাই। মাটিতে সকল প্রকার ফল-ফুল ও ফসলাদি জন্মে। যেমন-ধান, গম, ভুট্টা, আলু, পিয়াজ, মরিচ, হলুদ, রসুন, শাকসবজি, ফলমূল মাটিতে জন্মায়। এক কথায় প্রকৃতি ও জীবজগতকে আশ্রয় করেই আমরা জীবন ধারণ করে থাকি। নিঃশ্বাস ছাড়া যেমন মানুষ বাঁচতে পারে না, তেমনি প্রকৃতি, পরিবেশ ও জীবজগৎ ছাড়া মানুষের স্বাভাবিক জীবন-যাপন সম্ভব নয়।

এভাবে আমাদের সঙ্গে প্রকৃতি ও জীবজগতের নিবিড় সম্পর্ক বিদ্যমান। এদের যত্ন নেওয়ার জন্য ইসলামে নির্দেশনা রয়েছে। হাদিসে বর্ণিত হয়েছে-

ما مِن مُسْلِمٍ يَغْرِسُ غَرْسًا، أَوْ يَزْرَعُ زَرْعًا، فَيَأْكُلُ منه طَيْرٌ أَوْ إِنْسَانٌ أَوْ بَهِيمَةٌ إِلَّا كَانَ لَه بِهِ صَدَقَةٌ

উচ্চারণ: মা মিন্ মুসলিমিন্ ইয়ারিছু গাছান্ আও ইয়াজরাও যাত্মন্ ফাইয়াকুলু মিনহু তইরুন আও ইনছানুন আও বাহিমাতুন্ ইল্লা কানা লাহু বিহি সাদাকাতুন।

অর্থাৎ- "যখন কোনো মুসলমান একটি বৃক্ষ রোপণ করে অথবা কোনো বীজ বপন করে এবং সে গাছে ফল-ফলাদি-শস্য হয়, তা থেকে কোনো মানুষ বা পাখি বা পশু ভক্ষণ করে, তবে তা উৎপাদনকারীর জন্য সদকা (দান) রূপে গণ্য হবে"।

সুতরাং আমরা প্রকৃতি ও জীবজগতের প্রতি ভালোবাসাপূর্ণ আচরণের মাধ্যমে যত্নশীল হতে সচেষ্ট হবো।

ক) এক কথায় উত্তর বলি। কাজটি একাকী করি। 

১) মানুষ, প্রকৃতি ও জীবজগতের সৃষ্টিকর্তা কে? 

২) সূর্য থেকে আমরা কী পাই? 

৩) অক্সিজেন কোথা থেকে আসে? 

৪) কোথা থেকে আমরা কাঠ পাই? 

৫) আমরা প্রকৃতি ও জীবজগতের প্রতি কিরূপ আচরণ করব?

খ) বিষয়বস্তু পড়ি ও ভাবি। মানুষ, প্রকৃতি ও জীবজগতের পারস্পরিক সম্পর্ক বর্ণনা করে পাঁচটি বাক্য লিখি। কাজটি একাকী করি।

গ) আমরা যে প্রকৃতি ও জীবজগতের ওপর নির্ভরশীল সে সম্পর্কে একটি ছবি আঁকি।

জীব ও প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসা ও যত্নশীল আচরণ

নিচের ছবিটি দেখি। বলি তো একটি মেয়ে ও একটি ছেলে কীভাবে প্রকৃতির যত্ন নিচ্ছে? আমরা পরিবারে মা-বাবার স্নেহ, ভালোবাসা ও যত্নে বেড়ে উঠি। জীব ও প্রকৃতিরও পরিবার আছে। সেখানে তারাও পরিচর্যা পেয়ে বেড়ে ওঠে। আমরাও প্রকৃতি ও জীবজন্তুর পরিচর্যা করতে পারি। তাতে তারা ভালো থাকে। একটা গাছের যদি নিয়মিত যত্ন করা হয় তাহলে গাছটি ভালো ফুল ও ফল দেয়। তেমনি একটি গরুকে নিয়মিত যত্ন ও পরিচর্যা করলে বেশি দুধ দেয়। গাছপালা, বনাঞ্চল, পাহাড়-পর্বত, নদ-নদী এসবই প্রকৃতির অংশ। এগুলোর ক্ষতিসাধন করলে প্রাকৃ তিক দুর্যোগ দেখা দেয়। আমাদের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়ে। সুতরাং এগুলোরও পরিচর্যা করা প্রয়োজন। মহান আল্লাহর প্রতিটি সৃষ্টিকে ভালোবাসতে ও যত্ন করতে হবে। আল্লাহর সৃষ্টির প্রতি সদয় হলে আল্লাহ আমাদের প্রতি সদয় হন।

চিত্র: প্রকৃতি ও জীবজন্তুর পরিচর্যার দৃশ্য 

জীব ও প্রকৃতির প্রতি দয়া ও ভালোবাসা দেখানোর জন্য মহানবি (স.) বলেছেন,

ارْحَمُوا أَهْلَ الْأَرْضِ يَرْحَمُكُمْ مَنْ فِي السَّمَاءِ

উচ্চারণ: ইরহামু আলাল আরদি ইয়ারহামুকুম মান ফিস্ সামায়ি।

বাংলা অর্থ: "তোমরা পৃথিবীবাসীর প্রতি দয়া করো আসমানবাসী (আল্লাহ) তোমাদের প্রতি দয়া করবেন"।

আমাদেরকে মহান আল্লাহ সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী করে সৃষ্টি করেছেন। তাই আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে প্রকৃতি ও জীবজগতের প্রতি যত্নবান হওয়া। আমরা যদি গাছ লাগাই তবে পৃথিবী সবুজ-শ্যামল হয়। আমরা বেশি বেশি ফুল-ফল ও অক্সিজেন পাই। আর যদি গাছ কাটি পৃথিবীর ক্ষতি হবে। আমাদের খাদ্যের জন্য ফলমূল এবং বাঁচার জন্য অক্সিজেন পাবো না। তাই আমরা বেশি বেশি করে গাছ লাগাব। গাছ লাগানোর গুরুত্ব তুলে ধরে মহানবি (স.) বলেছেন, 'যদি নিশ্চিতভাবে জানতে পারো যে, কিয়ামত উপস্থিত, তখন যদি হাতে রোপণ করার মতো একটি গাছের চারা থাকে তবে সেই চারাটি রোপণ করবে।'

পশুপাখি কষ্ট পায় এমন কাজ আমরা করব না। আমরা পশুপাখির কষ্ট দেখলে সদয় হবো। অসুস্থ পশুপাখির সেবাযত্ন করব। তারা বিপদে-আপদে পড়লে আশ্রয় দেবো। অভুক্ত পশু- পাখিকে খাওয়ানো সওয়াবের কাজ।

আমরা আমাদের চারপাশের পরিবেশ পরিষ্কার রাখব। যেখানে সেখানে ময়লা-আবর্জনা ও থুতু ফেলব না। কেননা এর ফলে জীবাণু ছড়ায় ও বায়ু দূষিত হয়। প্লাস্টিক, পলিথিন, রাসায়নিক বর্জ্য ইত্যাদি পরিবেশ নষ্ট করে। পুকুর, খাল ও নদীতে ময়লা-আবর্জনা ফেললে পানি দূষিত হয়। কুরবানির সময়ে জবাইকৃত পশুর রক্ত ভালোভাবে পরিষ্কার না করলে পরিবেশের ক্ষতি হয়। সুতরাং আমরা এসকল কাজ করা থেকে বিরত থাকব।'

মাটি, বায়ু, পানি ও পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন যে কোনো কাজ ইসলামে নিষিদ্ধ। তাই পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ আমরা করব না। জীবজন্তুর মৃতদেহ বা উচ্ছিষ্ট যেখানে সেখানে না ফেলে মাটিতে গর্ত করে চাপা দিয়ে রাখব। বাড়িঘরের আবর্জনা এবং উচ্ছিষ্ট যেখানে সেখানে না ফেলে নির্দিষ্ট স্থানে ফেলব। প্রয়োজনে এসব আবর্জনা গর্ত করে মাটি চাপা দিয়ে রাখব। ধূমপান বায়ুদূষণ ঘটায়। তাই ধূমপান রোধে সচেতনতা তৈরি করব। এভাবে বিভিন্ন কাজের মাধ্যমে আমরা জীব ও প্রকৃতিকে ভালোবেসে তাদের প্রতি যত্নশীল আচরণ করব।

ক) বিষয়বস্তু পড়ি ও ভাবি। শুদ্ধ/অশুদ্ধ উত্তর চিহ্নিত করি। কাজটি একাকী করি।

১) জীব ও প্রকৃতির পরিবার আছে। শুদ্ধ/অশুদ্ধ

২) গাছপালা ও বনাঞ্চলের ক্ষতিসাধন করলে প্রাকৃতিক দুর্যোগ দেখা দেয় না। শুদ্ধ/অশুদ্ধ

৩) যেখানে সেখানে থুতু ফেললে জীবাণু ছড়ায়। শুদ্ধ/অশুদ্ধ

৪) ধূমপান বায়ুদূষণ ঘটায় না। শুদ্ধ/অশুদ্ধ

৫) পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন যেকোনো কাজ ইসলামে নিষিদ্ধ। শুদ্ধ/অশুদ্ধ

 ৬) কুরআন ও হাদিসে জীব ও প্রকৃতির পরিচর্যার নির্দেশ রয়েছে। শুদ্ধ/অশুদ্ধ

৭) জীব ও প্রকৃতির জন্য ভালোবাসা ও যত্নশীল আচরণ প্রয়োজন নেই। শুদ্ধ/অশুদ্ধ

খ) জীব ও প্রকৃতির যত্ন নিতে আমরা কি কি কাজ করব তা নিচের ঘরগুলোতে লিখি। কাজটি জোড়ায় করি।

গ) ইসলামের আলোকে জীব ও প্রকৃতির যত্ন নেওয়ার ভূমিকাভিনয় করি। কাজটি একাকী করি।

ঘ) বিদ্যালয় ও বাড়ির আশেপাশের জীব ও প্রকৃতির যত্ন নেওয়ার ব্যবহারিক অনুশীলন সম্পর্কে তালিকা তৈরি করি। কাজটি দলগতভাবে করি।

Content added By
Promotion